কলকাতা থেকে রওয়ানা দিয়ে বাইশ ঘন্টার ট্রেন যাত্রা শেষে আমরা পৌঁছেছি আগ্রায়। মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম নিদর্শন, ভারতবর্ষের অন্যতম পর্যটন-তীর্থ তাজমহলের আগ্রায়। শাহজাহান আর মমতাজমহলের অবিস্মরণীয় প্রেমের স্মারক আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। অন্যরকম আনন্দ খেলা করে সবার মধ্যে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের চেহারায় যেন নতুন এক আভা। যুগশ্রেষ্ঠ প্রেমের প্রতীকের সামনে হাতে হাত রেখে নতুন করে প্রেমের অঙ্গীকার করার অভিপ্রায় দুচোখেই পরিস্ফুট।
কিন্তু সেই তাজমহল দর্শন অত সহজ কম্ম নয়। আমরা বেড়াতে গেলাম আর দারোয়ান দরজা খুলে ‘আসুন জনাব, তসরিফ রাখুন’ বলে অভ্যর্থনা জানাবে ব্যাপারটি মোটেও তেমনটা নয়। ‘ফেল কড়ি, মাখো তেল’-এর উত্তর-আধুনিক সংস্করণের যুগ। নিজ দেশের মানুষের জন্য প্রবেশমূল্য কম হলেও ভিনদেশীদের কড়ির বদলে কাড়ি কাড়ি টাকা, রূপী বা ডলার খসাতে হয়। প্রবেশমূল্য এখানে রূপীতেই। টাকা বা ডলার আগে ভাঙিয়ে নিতে হয়। দেশীরা বিশ রূপীতে ঢোকার সুযোগ পেলেও বিদেশীদের গুণতে হয় গুণে গুণে ৪৮ গুণ, ৯৬০ রূপী। কোন এক সময় বাংলাদেশ ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হলেও আমরা তো আর ১৯৪৭ সালের আগে তাজমহল দেখতে যাচ্ছি না। আমরা যাচ্ছি ২০০২- এ। ’৪৭-পূর্ব যুগে গেলে হয়তো আমরাও একই মূল্য গুণতাম। এবং সেটা ২০ রূপীর চেয়ে অনেক কম-ই হতো।
যা-ই হোক, আমরা তো আর অত রূপী খরচ করবো না। তাজমহলের সাথে জড়িত আবেগ হৃদয়কে যতই স্পর্শ করুক, ভাবাবেগে উদ্বেলিত করুক, আমাদের অধিকাংশেরই হৃদয় অতোটা বড় নয় যে চারশ-পাঁচশ বছর পুরনো একটা ‘মসজিদ-মতো দালান’ দেখতে প্রায় হাজার রূপী ব্যয় করবো। দু’একজন হয়তো অন্য কোন উপায় না থাকলে তা-ই করতো। কিন্তু ‘দশজনে করে যাহা, তুমিও করিবে তাহা’ ফর্মূলায় বাকিরা ২০ রুপীতে গেলে তারাও ২০ রূপীতেই যাবে- নচেৎ নয়- এই রূপই স্থির হলো।
২০ রূপীতে যে আমাদের পক্ষেও তাজমহলের ভেতর ঢোকা সম্ভব - এই ব্রেকিং নিউজটা দিয়েছেন আমাদের গাইড ফাহিম ভাই। যে ট্যুরিজম কোম্পানী আমাদের সাথে ভ্রমণ- সংক্রান্ত চুক্তিতে আবদ্ধ, যারা ঢাকা মেডিক্যালের তৃতীয় বর্ষের পঁচাত্তর জন ছাত্রছাত্রীকে হিন্দুস্তানের কতিপয় দর্শনীয় স্থান চাক্ষুষ করানোর গুরুভার নিজ স্কন্ধে নিয়েছেন (অবশ্যই নগদ নারায়ণের বিনিময়ে), ফাহিম ভাই তার সর্বে-সর্বা। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শুরু হলো আমাদের ‘অপারেশন তাজমহল এন্ট্রেন্স’-এর প্রস্তুতি।
ফাহিম ভাই প্রথমেই জানিয়ে দিলেন, বিশাল আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজন প্রথমেই নিজেকে ভারতীয় বলে প্রমাণ করা। সানি দেওলের মতো ‘ম্যায় হু ইন্ডিয়ান’ বলে চিৎকার করে দুনিয়াকে জানান দেওয়ার প্রয়োজন নেই, তাজমহলের গেটে ঢোকার সময় দ্বাররক্ষী যদি সন্দেহবশত জিজ্ঞাসা করে , তবেই কেবল নিজেকে ভারতীয় বলে পরিচয় দিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো - ঐ দ্বাররক্ষীরা কি এতই ভদ্র ও আহাম্মক যে, আমি বলব- আমি ভারতীয় আর সঙ্গে সঙ্গে সেলাম ঠুকতে ঠুকতে বিশ রূপীর টিকিট হাতে নিয়ে আমাকে ঢুকতে দেবে? উঁহু , ব্যাপারটা মোটেই অতো সহজ না। দ্বাররক্ষী যখন নিবাস জানতে চাইবে, ভারতের কোন একটা এলাকার নাম বলতে হবে। যেমন, কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লী. ব্যাঙ্গালোর ইত্যাদি। অতো বড়ো এলাকার নামে দ্বাররক্ষী সন্তুষ্ট না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে জানতে চাইতে পারে, কলকাতার কোথায়, বলতে হবে, মেদিনীপুর, বসাক লেন বা ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ইত্যাদি। বলতে হবে বাড়ির নম্বর। যে এলাকার নাম বলবো ঐ এলাকার রাজ্যসভা-লোকসভার সদস্য, মূখ্যমন্ত্রীদের নাম জানতে হবে। ঐ এলাকার পূর্ব-পশ্চিম- উত্তর-দক্ষিণের এলাকাগুলোর নামও জানতে হবে। জানতে হবে, এলাকার বিখ্যাত কোন স্থাপনা বা ভবনের নাম। মোট কথা, ভারতের সরকারী ক্যাডার সার্ভিসের প্রিলি পরীক্ষার ‘স্বদেশ’ অংশের প্রশ্নোত্তরের জন্য তারা যেরকম পড়াশোনা করেন, ঠিক সেরকম না হলেও এক রাতে আমাদেরকে তার কাছাকাছি পর্যায়ের পড়াশোনা করতে হবে।
অবশ্য আমাদের বইপত্র পড়ার দরকার নেই। ফাহিম ভাই-ই জলজ্যান্ত সংক্ষিপ্ত ভারতকোষ। তার লব্ধ জ্ঞানের কিয়দংশ আমরা ধারণ করার চেষ্টা করি। দিল্লী, মুম্বাই বলে ধরা খাবো নাকি? হিন্দির ‘হ’-ও জানি না। যারা জানে, তারা এই সব নামী-দামী শহরজাত বলে নিজেদের পরিচয় দেয়ার অধিকার পেল, সেইসব শহরের সাধারণ জ্ঞানে নিজেদের সমৃদ্ধ করলো। আমার মতো আকাট-মূর্খ, ‘ক্ষ্যাত’ শ্রেণীর মানুষের শেষ ভরসা হলো কলকাতা। তা-ও বাংলাটা কিঞ্চিৎ ঘষামাজা করতে হলো। খেলুম-গেলুম আর দাদা-দিদি চর্চা করলুম কিছুক্ষণ।
শুধুমাত্র সাধারণ জ্ঞান চর্চার মধ্যেই প্রস্তুতি সীমাবদ্ধ রইলো না। ফাহিম ভাইয়ের আরো কিছু ইনস্ট্রাকশন ফলো করতে হলো। সঙ্গে পাসপোর্ট বা পরিচিতি জ্ঞাপক কোন ধরণের কাগজপত্র তো হারামই, অন্য কোন কাগজপত্র, মানিব্যাগ, টাকা পয়সা ইত্যাদি নিতেও নিরুৎসাহিত করা হলো। শুধু ক্যামেরা হাতে থাকবে। সাজপোশাক সাধারণ, দৃষ্টি কাড়তে পারে এমন সকল সাজ বর্জনীয়। মেয়েদের এমন সাজ ও সজ্জা পরিহার করতে বলা হলো যা দ্বাররক্ষীদের তাদের প্রতি কিঞ্চিত সময়ও বেশী দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে উৎসাহিত করতে পারে। যত বেশী সময় দ্বাররক্ষীদের কাছাকাছি থাকা হবে, তত বেশী ধরা পড়ার আশংকা। আর সবচেয়ে বড় কথা- ‘সবার উপরে আমি সত্য ,তাহার উপরে নাই’। প্রত্যেকে একা ঢুকবে, সর্বোচ্চ একসাথে দুইজন। কাউকে ধরা পড়তে দেখলে তার সাহায্যে অন্য কারো এগিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। ধরা পড়লে শাস্তি তেমন নাই, শুধু ধৃত ব্যক্তি তাজমহলে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু সাহায্য করতে গিয়ে অন্যরা ধরা পড়তে থাকলে পুরো দলেরই তাজমহল দর্শনেচ্ছা অপূর্ণ থেকে যেতে পারে। যে ভেতরে যেতে পারবে না, সে তাজমহলের গেট থেকে একটু দূরে রাস্তার ধারে অপেক্ষা করবে- কতক্ষণ অপেক্ষা করবে তার অবশ্য কোন টাইম-টেবিল নেই। তাজ-দর্শন শেষে ফাহিম ভাই যেভাবে হোক তাদের খুঁজে নেবেন। আর হ্যাঁ, ট্র্যাভেল এজেন্সীর কোন গাড়ি তাজমহলের দুই কিলোমিটারের মধ্যেই থাকবে না।
ভিতরে গিয়েও এমন ভাবে ঘুরতে হবে যেন কেউ কাউকে চিনি না। ঘন্টা দু’তিন পরে চারদিকের অবস্থা বুঝে একত্রিত হওয়া যাবে। ভেতরে চেকিং বা পরিস্থিতি খারাপ বুঝলে একত্র হওয়ারও দরকার নেই। অচেনা কারো সাথে খোশ-গল্প জুড়ে দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
তো - আমরা দুপুরের খাওয়া সেরেই রওয়ানা দিলাম। এবার আর অন্যবারের মতো সবাই দুই বাসে ভাগ হয়ে না, অসংখ্য টুকরায় ভাগ হয়ে রওয়ানা দিলাম তীর্থস্থানের দিকে । আমি যে টুকরায়, সেখানে আরও তিনজন- সহপাঠী রনি, মোর্শেদ আর আমাদের সাথে যাওয়া একমাত্র শিক্ষক। হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিলাম। সে ট্যাক্সিও থামলো তাজমহলকে অনেকখানি দূরে রেখে। তারপর চারজন পরস্পরের কাছ থেকে এমনভাবে বিদায় নিলাম যেন বহুদিনের জন্য প্রবাসে চলে যাচ্ছি আমরা। গিয়ে দাঁড়ালাম টিকিটের লাইনে । রনি আমার আগে টিকিট কিনলো।
ভাগ্য ভালো, কোন শব্দ উচ্চারণ না করেই টিকিট কিনতে পারলাম। টিকিট নিয়ে দাঁড়ালাম প্রবেশ লাইনে। আমার সামনে একজন, তার সামনে রনি। রনির পকেটে হাত দিল গার্ড। পকেট থেকে বের করলো ক্যামেরাটা। এই বের করার ফাঁকেই জিজ্ঞেস করলো, সে কোথা থেকে এসেছে। শেখানো মতো শহরের নাম বললো রনি। তার আর জ্ঞানের পরীক্ষা নিল না গার্ড। আমি আরও ঝুঁকিহীন থাকার জন্য পকেটের ক্যামেরাাটা হাতে নিলাম। গার্ডের সামনে দাঁড়লাম। গার্ড আমার শার্টের পকেট বরাবর হাত দিল, প্যান্টের পকেটগুলোর উপরও হাত রাখলো। কিছুই তো নেই, পাবে আর কি? হাত ইশারায় ভিতরে যেতে বললো গার্ড। শেষ? আমি বিস্মিত! ভিতরে ঢুকে খানিক ক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এত সহজে হয়ে গেল সবকিছু! কিছুই তো জিজ্ঞেস করলো না! একদম কোন প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়েই ঢুকে গেলাম তাজমহলের গেট দিয়ে! ওদের কোনই সন্দেহ হলো না? একদিকে বিনা ঝামেলায় ভিতরে ঢুকতে পেওে যেমন আনন্দে উৎফুল্ল আমি, তেমনি অন্য দিকে গার্ডদের উপর কিছুটা মনক্ষুণœও হলাম। কিরে বাপ! এত কষ্ট করে সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করলাম, একটু পরীক্ষাও নিবি না!
রওয়ানা দিলাম এবার তাজের মূল ভবনের দিকে।
............................
সবাই কিন্তু আমার মতো এতো সহজে পার পায়নি সেদিন। অনেককেই জ্ঞানের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তবে মেয়েদেরকে তেমন জিজ্ঞাসবাদ করা হয়নি। এমনকি জুটি বেঁধে ছেলে-মেয়ে যারা একসাথে গেছে, তারাও ঢুকেছে বিনা বাধায়। নাদিম প্রশ্নোত্তর পারা সত্ত্বেও প্রথমে তাকে ঢুকতে দেয়নি গার্ড। পরে গার্ডদের শিফট বদল হলে সে শার্ট বের করে প্যান্টের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে, চুলটা খানিক এলোমলো করে অন্য গার্ডের সামনে দিয়ে ঢুকেছে। ইমতিয়াজ ধরাই পড়েছে। কিন্তু সে উল্টো গার্ডের সাথে গলাবাজি করে, ‘আমি ঢাকা মেডিক্যালে পড়ি, কলকাতা মেডিক্যালে আমার ফ্রেন্ড পড়ে, আমি ওর আমন্ত্রণে এসেছি, আমি তো বাঙালী, আমি কেন ঢুকতে পারবো না’ ইত্যাদি বলে ঢুকেছে। হাসানকে ভারতীয় বলে মানতে চায়নি গার্ড। অবশেষে সে বলেছে, সে থাকে আমেরিকায়, ওকলাহামা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ভারতে নানা বাড়ি তার, বেড়াতে এসেছে। হাসান ফিরিঙ্গিদের মতো ফর্সা, চালচলনে স্মার্ট আর ফটর ফটর ইংরেজী বলায় গার্ড শেষ পর্যন্ত ভিরমি খেয়ে তাকে ঢুকতে দিয়েছে। ধরা খেয়েছেন আমাদের সাথে যাওয়া একমাত্র শিক্ষকও। তবে তিনিও তাজমহল দর্শন থেকে বঞ্চিত হননি। শুধু গার্ডদের হাতে উপরি দুইশ রূপী ধরিয়ে দিতে হয়েছে।
ঘুষ কোথায় না চলে!